গৃহস্থালি রান্নার কাজে জ্বালানি সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রান্নার কাজে গ্যাস বা এলপিজি দেশের রাজধানী ছাড়া কয়েকটি বিভাগীয় শহরের অল্পবিস্তর প্রয়োজন মেটাতে পারলেও সিংহভাগ জনগণের রান্নার জ্বালানি মেটাতে হয় কাঠ বা খড়ি দিয়ে। আর গ্রামাঞ্চলে এখনও গবাদিপশুর বর্জ্য দিয়ে পাটখড়ির সাহায্যে ঘুটে বা মুঠে দিয়ে রান্নার কাজ চালানো হয়ে থাকে। গবাদিপশুর বিষ্ঠা বা গোবর এখনও ফসলি মাঠে একমাত্র জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাঠের ওপর চাপ কমিয়ে আধুনিক চুলা আমাদের জ্বালানি সাশ্রয়সহ জৈব সারের ঘাটতি লাঘবে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। খুলনা শহরের বয়রা এলাকার মো. ইউসুফ আধুনিক প্রযুক্তির চুলা উদ্ভাবন করেছেন যা দিয়ে গ্রামাঞ্চলসহ শহরের আধুনিক রান্নাঘরে অনায়াসেই অল্প পরিমাণে জ্বালানি কাঠ দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করা যায় এবং ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশে গৃহিণীরা রান্নার কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। মো. ইউসুফ উদ্যোমী এক ব্যক্তি। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায়। জীবিকার প্রয়োজনে খুলনায় এসেছিলেন। খুলনার শিল্পাঞ্চলখ্যাত খালিশপুরে মিলে চাকরিও পেয়েছিলেন। নিজের জীবনটা যখন সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি হয়েছিলেন তখনই মিলটি লোকসানের বোঝা নিয়ে কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়। দিশেহারার মতো হয়ে যান ইউসুফ। জীবন চালাতে তখন কাপড়ের ছিদ্র মেরামতের রিপুর কাজ শুরু করেন। সাংসারিক রান্নার প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে একটি চুলা তৈরি করে নিয়েছিলেন। কিছু দিন না যেতেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। নিজে নিজেই মেরামত করে সেটিকে ঠিক করেন তিনি। এ কাজের মাধ্যমেই চুলা তৈরি ও বিপণনের প্রতি উৎসাহিত হন ইউসুফ। প্রযুক্তির চুলার বিষয়ে খোলামেলা কথা হয় তার সঙ্গে।
প্রশ্ন : চুলার বিষয়ে আগ্রহী হলেন কেন?
উত্তর : চাকরি হারানোর পর জীবিকার তাগিদে কাপড় রিপুর কাজ শুরু করি, কিন্তু এ কাজে সাংসারিক প্রয়োজন না মেটায় নতুন কাজ খুঁজতে থাকি। এ সময় নিজের চুলা মেরামত করতে গিয়ে চুলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি।
প্রশ্ন : কবে থেকে চুলা তৈরি শুরু করেছেন?
উত্তর : আমি ২০০০ সাল থেকে মূলত চুলা তৈরির কাজ শুরু করেছি। সেটিকে আধুনিক রূপ দিয়ে ২০০২ সাল থেকে উন্নত চুলার রূপ দিয়েছি। এ সময় থেকে চুলা বিক্রির কাজও শুরু করেছি।
প্রশ্ন : আপনি কত ধরনের চুলা তৈরি করেন?
উত্তর : আমি তিন ধরনের চুলা তৈরি করি। ছোট, মাঝারি ও বড় চুলা। এসব চুলা আবার তিনভাবে তৈরি করে থাকি। চিকন স্ট্রাকচার, মাঝারি স্ট্রাকচার ও মোটা স্ট্রাকচার। ছোট চুলা ৪ থেকে ৫ জনের রান্নার জন্য, মাঝারি চুলা ৫ থেকে ১০ জন ও বড় চুলা ১০ থেকে ২০ জনের রান্নার জন্য। এছাড়া হোটেল বা মেসের জন্য আলোচনা করে বড় চুলা তৈরি করে থাকি।
প্রশ্ন : একটি চুলা বানাতে কয় দিন সময় লাগে?
উত্তর : ছোট চুলা বানাতে ১৫ দিন সময় লাগে, বড় চুলা বানাতে ২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
প্রশ্ন : আপনি চুলা কিভাবে তৈরি করে থাকেন?
উত্তর : ক্রেতা কত বছর মেয়াদি, কোন আকারের চুলা তৈরি করতে চান সেটিকে বিবেচনায় এনে চুলা তৈরির কাজ শুরু করি। প্রথমে স্ট্রাকচার রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হয়, পরে মাটি ও অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে সেটিকে তরল করে সপ্তাহখানেক শুকিয়ে কাদা বানিয়ে টব তৈরি করা হয়। এবার ওই স্ট্রাকচারের ভেতর টবটি বসিয়ে দেয়া হয়। স্ট্রাকচার ও টবের মাঝখানের ফাঁকে নিজস্ব তৈরিকৃত কিছু পদার্থ প্রয়োগ করে পরে সিমেন্ট বালু দিয়ে পুনরায় সেটিকে লেপে চুলা তৈরির কাজ শেষ করে থাকি।
প্রশ্ন : আপনি এ পর্যন্ত কতটি চুলা তৈরি করেছেন?
উত্তর : আমি এখন পর্যন্ত ৩ হাজারের বেশি প্রযুক্তির চুলা তৈরি করেছি। দেশের ১৭টি জেলার বিভিন্ন পেশার ব্যক্তির নিকট এসব চুলা বিক্রি করেছি।
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর : আমাদের দেশের সাধারণ মানের চুলায় গৃহিণীরা যে পরিমাণ কাঠ অপচয় করেন সেক্ষেত্রে আমার এ প্রযুক্তির চুলায় শতকরা প্রায় ৩৪ ভাগ জ্বালানির সাশ্রয় হবে। ফলে দেশের বনজ সম্পদ ও পরিবেশ অনেকাংশে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। ভবিষ্যতে আমার এ তৈরিকৃত প্রযুক্তির চুলাকে দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করতে ইচ্ছুক।
দেশের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সম্মানিত পরিবেশবিদরা যেভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন মো. ইউসুফের চিন্তাভাবনা তাদের এ আন্দোলনকে কিছুটা হলেও এগিয়ে দিতে পারে। তার উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তির চুলা আরও আধুনিককায়নের মাধ্যমে জ্বালানি সাশ্রয়সহ পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখুক এটাই আমাদের কাম্য।
লেখক:
মো. আবদুর রহমান*
* এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, খুলনা